অপ্রচলিত ভেষজ চা [২য় পর্ব]
এটি “অপ্রচলিত ভেষজ চা” সিরিজের ২য় পর্ব। প্রথম পর্বে জবা ফুলের চা, মেস্তা চা বা রোজেলা টি, জিরা চা, এবং অরিগ্যানো চা – এগুলো সম্পর্কে জেনে ছিলাম। এই পর্বে আরো নতুন কিছু অপ্রচলিত ভেষজ চা সম্পর্কে জানব।
অপরাজিতা চা
এই পর্বে প্রথমে কথা বলব অপরাজিতা ফুলের চা সম্পর্কে। অপরাজিতা ফুল কম বেশি আমরা সবাই চিনি। যারা ছাদ বা বারান্দায় বাগান করেন তারা এই গাছটি সংগ্রহ করে থাকে। যদিও অপরাজিতার চা এর ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা নেই। এ্যান্টি অকসিডেন্ট এ ভরা এই পানীয় খেতে যতটা সুস্বাদু তার চেয়েও সুন্দর এই চায়ের রং। অপরাজিতা, শিম পরিবারের (Fabaceae) লতানো উদ্ভিদ।
অন্যান্য নামঃ নীলকণ্ঠী
ইংরেজি নামঃ Butterfly pea / Blue pea vine / Blue Bell Vine / Mussel-shell climber / Pigeon wings / Asian Pigeon-wings /
বৈজ্ঞানিক নামঃ Clitoria ternatea L
যেভাবে তৈরি করবেনঃ
এই চা বানানোর প্রক্রিয়া বেশ সহজ। সুবিধা হয় যদি আগে থেকে ফুল সংগ্রহ করে শুকিয়ে বোতল বা জারে সংরক্ষণ করা যায়। চা বানাবার জন্য এক কাপে ৫/৬ টি শুকনো ফুল দিয়ে তার মধ্যে ফুটন্ত গরম পানি দিতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যাবে ফুল গুলো সাদা রং ধারণ করেছে এবং পানি নীল রং ধারণ করছে। এবার এটা সরাসরি খেতে পারবেন আবার স্বাদের জন্য চিনি বা মধু ও দিতে পারবেন। চাইলে লেবুর রস ও দেওয়া যায়, লেবুর রস প্রয়োগ করলে নীল রং থেকে ম্যাজেন্টা রং ধারণ করবে। চাইলে এই চা ঠান্ডা করে বরফ যুক্ত করে শরবত হিসেবেও খেতে পারবেন।
অপরাজিতা ফুল দিয়ে শুধুমাত্র চা বা শরবত বানানো যায় তা কিন্তু না, এটার এই প্রাকৃতিক নীল রংকে ফুড কালার হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। এই রং দিয়ে ভাত , পোলাও, মিস্টি, পিঠা, পায়েস হয় যে কোন খাবারকে রাঙাতে পারবেন।
উপকারিতাঃ
– অপরাজিতা ফুলের চা রোগপ্রতিরোধ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি কাশি নিরাময় এবং ঠান্ডাজনিত সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।
– অপরাজিতা ফুলের চা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
– অপরাজিতা ফুলের চা পলিফেনল ও ফ্লাভোনয়েড যৌগ লিভার এনজাইমের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে লিভারের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
– এ চায়ে থাকা স্যাপোনিন এবং ফ্লাভোনয়েড যৌগ অ্যাজমা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
– অপরাজিতা ফুলের চা স্মৃতিশক্তিবর্ধক হিসেবে আলজাইমার রোগের (Alzheimer’s Disease) চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
লেমন গ্রাসের চা
লেমন গ্রাস আমাদের সকলের পরিচিত ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এটি প্রায় সকল নার্সারিতেই পাওয়া যায় এবং অনেক বাগানি এটি সংগ্রহে রাখে। এটি টবে চাষ করা খুবই সহজ। দেখতে কিছুটা ঘাসের মত এবং দ্রুতই বৃদ্ধি পায়। হোটেল রেস্তোরা গুলোতে লেমন গ্রাস স্যুপ ও অন্যন্ন খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য নামঃ গন্ধতৃণ / গন্ধবেণা / থাই পাতা / চাইনিজ পাতা / লেবু ঘাস
ইংরেজি নামঃ Lemon grass / Oil grass / Barbed wire grass / Silky heads / Citronella grass / cha de Dartigalongue / Fever grass / Tanglad / Hierba Luisa / Gavati chaha
বৈজ্ঞানিক নামঃ Cymbopogon citratus
এই উদ্ভিদটির মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে, এটির পাতা এবং ডাঁটা লেবুর সুগন্ধযুক্ত তবে তা লেবুর চেয়েও কিছুটা মিষ্টি স্বাদের। যার ফলে এটি খাবারে স্বাদ বাড়ানোর কাজে লাগে এবং অনেক গুলো ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। লেমন গ্রাস এর পাতা থেকে সুগন্ধী তেল ও উৎপাদন হয়। তেল উৎপাদনের জন্য বিশ্বের অনেক দেশে লেমন গ্রাসের চাষ হয়। এই তেল কীটনাশক ও খাবার সংরক্ষণে ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে আজকে আমরা শুধুমাত্র লেমন গ্রাস এর চা নিয়েই আলোচনা করব।
যেভাবে তৈরি করবেনঃ
লেমন গ্রাস শুকনো, গুঁড়া অথবা তাজা অবস্থায় ব্যবহার করা যায়। পরিমাণ অনুযায়ী লেমন গ্রাসের পাতা ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। তারপর পানিতে পাতা গুলো কুচি করে কেটে দিতে হবে এবং জাল করে পানির পরিমাণ কমাতে হবে তারপর পরিমাণ মত চা-পাতা দিতে ৫/৮ মিনিট পরে চুলা থেকে নামিয়ে পরিমাণ মত চিনি যোগ করতে হবে। হয়ে গেলো “লেমন গ্রাসের চা”। স্বাদ বাড়ানোর জন্য এবং স্বাদের ভিন্নতার জন্য কিছুটা আদাও যোগ করা যেতে পারে।
চা পাতা ছাড়া ও এই পানীয় খাওয়া যায় আবার প্রচলিত নিয়মে চাপাতা দিয়ে পরে লেমন গ্রাস যোগ করেও চা বানানো যায়।
উপকারিতাঃ
– লেমন গ্রাস এ সাইট্রাল নামক উপাদান বিদ্যমান থাকায় হজম শক্তি বাড়ায় এবং বদহজম, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য জাতীয় পেটের রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
– লেমন গ্রাস উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি পটাশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় প্রস্রাবের এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে রক্ত প্রবাহকে উত্তেজিত করে রক্ত চাপ কমাতে ভুমিকা রাখে।
– লেমন গ্রাস বিপাক প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে তুলে যার ফলে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয় সেই সাথে এটি ক্যালরি হ্রাস করতেও ভূমিকা রাখে।
– এটি ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’ তে পরিপূর্ণ বিধায় ত্বক এবং চুলের জন্য উপকারী।
– হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। লেমন গ্রাস এ ফলিক এসিড, তামা, থায়ামিন, লৌহ, দস্তা ইত্যাদি উপস্থিত থাকায় এটি রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
– লেমন গ্রাসের চা সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি মোকাবিলায় সাহায্য করে কারণ এটি অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল গুণে সমৃদ্ধ। লেমন গ্রাস, তুলসী পাতা এবং এলাচের গরম মিশ্রণ সর্দি কাশির সমস্যায় তাৎক্ষণিক কাজে দেয়।
– উপরিউক্ত উপকারিতা গুলো ছাড়াও, লেমন গ্রাসের চা আর্থারাইটিসের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। লেমন গ্রাসের তেল প্রয়োগ করেও আর্থারাইটিস, রিউমাটিজম, গাউট ও গাঁটের ব্যাথার সমাধান পাওয়া যায়। লেমন গ্রাসের চা কোলেস্টেরল ও রক্তের গ্লুকোজ মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
“অপ্রচলিত ভেষজ চা” সিরিজের ২য় পর্বে আমরা ২ ধরণের চা এর ব্যাপারে জানলাম। পরের পর্ব গুলোতে আরো কিছু ভেষজ চা সম্পর্কে জানব যেগুলো সহজেই ঘরে বানানো সম্ভব।