আসশেওড়া, মটকিলা – পরিচিতি, ঔষধী গুণাগুণ এবং বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ
বাংলা নামঃ মটকিলা, আশশেওড়া, আটেশ্বর, মৌ ডাল ইত্যাদি
আঞ্চলিক নামঃ এই গাছের অনেক গুলো আঞ্চলিক নাম আছে। চেনার সুবিধার জন্য অনেক গুলো আঞ্চলিক নাম যুক্ত করা হলো –
ফটিকগীলা
দাঁতন ফল
মৌলটা গাছ
আটিস্বর/ আতিস্বর, দাঁত ছুলা – (নওগাঁ)
আর্শেল ফল
আইস্টালি গাছ – (মাদারীপুর)
আট-শ্যওড়া
কাউয়াঠুনি / ফটিকখিরা / কাউয়াঠোটি
আইডালি
বনজামির
আধছুটি
মৈলটা
মরিচ্ছা পাতা
আশটালি
আঁটি সোহরা – (চাঁপাই নবাবগঞ্জ)
কায়াফল গাছ (কুষ্টিয়া)
গোয়ালসাপটা, কায়েফলা – (পাবনা)
কায়া বওলা
ফটিক খিরা
সাবড়া কুল
আসকুলি
আধছটি
পেপুটি
এটুলি
বৌরী
শুঁটি
আদিবাসি নামঃ তাতিয়াং (মারমা), হতিজ্ঞিরা (চাকমা), সি মা সেরে (মারমা), মোয়াতন (গারো)
ইংরেজি নামঃ Gin berry / Ginberry Toothbrash plant , Motartree , Orangeberry
বৈজ্ঞানিক নামঃ Glycosmis pentaphylla
পরিচিতিঃ
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে আসশেওড়া গাছটি দেখতে পাওয়া যায়। অঞ্চল ভেদে এর আঞ্চলিক নামেও ব্যাপক বৈচিত্র দেখা যায়। এটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছ ৩ থেকে ৪ ফুট উচু হয় তবে অনেক ক্ষেত্রে ৬/৭ ফিট ও হয়ে থাকে। এই গাছের ফুল খুবই ছট সাইজের সবুজাভাব সাদা রঙের হয়ে থাকে। এর এক থোকায় ২০-৫০টি ফল দেখা যায়। ফল পাকলে গাড় গোলাপি রং ধারণ করে। ফল রসালো এবং কিছুটা মিস্টি স্বাদের। এই ফল পাখিদের বেশ পছন্দের খাবার। শিশুরার মজার ছলে খেয়ে থাকে। এই গাছের ফল সারা বছরই থাকে আর গাছ স্বাভাবিক ভাবে ৫-৭ বছর বাঁচে। বীজ থেকে চারা হয় এবং কাটিং থেকে সহজেই চারা তৈরি করা যায়। এই গাছ দুই বাংলার আনাচে কানাচে সহজেই যত্র-তত্র বেড়ে উঠার অন্যতম অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে কোন ধরনের তৃণভোজী পশু পাখি এর পাতা খায় না।
ঔষধী গুণাগুণঃ
– আসশেওড়ার সমগ্ৰ গাছেরই আ্যন্টিফাঙ্গাল, আ্যন্টিব্যাকটেরিয়াল ও আ্যস্ট্রিনঞ্জেট ক্ষমতার জন্য আমাশা, রক্তামাশায় খুব কার্যকরী।
– এই গাছের পাকা রসালো ফল জন্ডিস, লিভারের অসুখ, কাশি, বাত, রক্ত শূন্যতায় উপকারী।
– গাছের ছাল বাত ও গোদ রোগে ভালো কাজ করে।
– এই গাছের ডাল দাঁতন কাঠি হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ। আশশেওড়ার নরম ডাল দিয়ে নিয়মিত দাঁত মাজলে দাঁত পরিস্কার থাকে, দাঁতের মাড়ি শক্ত করে এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।
– এর ডাল দিয়ে দাঁতন করলে দাঁতের পায়োরিয়া নাশ করে।
– ফলের রসে কাগজ ভিজিয়ে সেই শুকনো কাগজের ধোঁয়ায় ধূমপান করলে ফ্যারিঞ্জাইটিস,
ল্যারিঞ্জাইটিস, গলক্ষত ও শ্বাসকষ্ট কমে।
– মূলের রস চিনিসহ হালকা ঘুষঘুষে জ্বর কমায়।
– পাতার রস লিভার ও স্পিন বৃদ্ধিতে ভাল কাজ দেয়।
– যাদের পা ফাটে, এমনকী বারোমাসই ফেটে থাকে তাঁরা আসশেওড়া পাতার রস নারকেল তেলের সঙ্গে ফুটিয়ে নিয়মিতভবে লাগাবেন, খুব দ্রুত আরায় পাবেন।
– এই গাছের পাতা ফোটানো পানি দিয়ে নিয়মিত দিনে ২ বার ধুলে যেকোনো ঘা ভালো হবে।
আরো কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগঃ
– বিচুটিগাছ গায়ে লাগলে প্রচণ্ড চুলকায়। আসশ্যাওড়া গাছের পাতা ডলে সেই জায়গায় লাগলে সঙ্গে সঙ্গে চুলকান বন্ধ হয়ে যায় এবং অনেক সময় বিচুটিগাছ আর আসশ্যাওড়া গাছ কাছাকাছি জন্মাতে দেখা যায়।
– পাতার রস হাতে পায়ে মেখে মাছ ধরতে বসলে মশা দূরে থাকে।
– ফোড়া হলে এই গাছের শিকড় পাটায় ঘষে তা ফোড়ায় প্রলেপ দিলে তাড়াতাড়ি পেকে যায়।
– এই পাতার রস বাচ্চাদের জন্য খুব উপকারী। বিশেষতঃ কৃমি নিয়ন্ত্রণ করে।
– হাতির দাঁতের ওপর জমে থাকা ময়লা এ গাছের পাতা দিয়েই পরিস্কার করে পালিশ করা হয়।
– এই গাছের পাতা বাজানো যায় বাশিঁর মত করে।
– এই গাছের পাতা আম পাকানোর জন্য জাগ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।
আসশেওড়া বা মটকিলা গাছের প্রায় সব অংশই ঔষধের কাজে লাগে। এই গাছ ট্র্যাডিশনাল মেডিসিনে প্রায়ই ব্যবহার করা হয় এককভাবে অথবা অন্যান্য উপাদানের সাথে মিশ্র ভাবে। ভিয়েতনামে এই গাছের পাতা থেতলিয়ে মহিলাদের প্রসবের পর ক্ষুধা বৃদ্ধির জন্য খাও্যানো হয়। এই গাছ থেকে বানানো ঔষধ ডায়রিয়া, বাতজ্বর, রক্তশূন্যতা, চর্মরোগ ও জণ্ডিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, আসশেওড়া বা মটকিলা গাছের যেমন অনেক ব্যবহারিক গুণ আছে তেমনি এটির ঔষধী গুণাগুণ ও অনেক। দুই বাংলার আনাচে কানাচে, যত্র-তত্র এই গাছটি সহজে জন্মায় বলে এটি বিশেষ ভাবে সংরক্ষণের ও আপাতত প্রয়োজন পড়েনি। এই গাছের নাম যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পাওয়া যায় তেমনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পথের পাঁচালী উপন্যাসেও এটির নাম পাওয়া যায়।
এই লিখাটির উদ্দেশ্য, আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অমূল্য এই গাছটিকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং এগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি।
বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ, পত্রিকা থেকে সংগ্রহ