Uncategorized

ধুতুরাঃ শুধুই কি বিষাক্ত ফুল ?

সাদা ধুতুরা, photo credit: fairdinkumseeds

আমাদের কাউকে যদি একটা বিষাক্ত গাছের বা ফুলের নাম বলতে বলা হয় তাহলে সবার আগে মাথায় আসে ধুতুরা’র নাম। এটা এমন একটা গাছ যার প্রায় সবটাই বিষাক্ত। Tropane Alkaloids নামক এক ধরণের বিষের উপস্থিতি আছে এই গাছে যা মানুষ এবং পশুপাখির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আমাদের মধ্যে শুধু এই টুকুই প্রচলিত যে, ধুতুরা বিষাক্ত কিন্তু এটা যে একটা বিষাক্ত গাছ হয়েও এর অনেক গুলো ভেষজ গুণ আছে তা অনেকেই জানি না। এই লিখায় আমরা ধুতুরা সম্পর্কে বিস্তারিত জানব –        

অন্যান্য ও আঞ্চলিক নামঃ ধুতরা / ধতুরা / ধোবা / মাদকুণিকে / উন্মেত্তচেটু / ধংতুরী

ইংরেজি নামঃ Horn of Plenty / Devil’s Trumpet / Datura double purple / Jimson Weed / Evil’s snare / Thorn apple / metel.

বৈজ্ঞানিক নামঃ Datura metel

সংস্কৃতঃ ধুতুরা / ধত্তূর / কিতব / ধূর্ত্ত / দেবতা / মদন / শঠ / উন্মত্ত / মাতুল / তূরী / তরল / কনকাহবয়

আরবীঃ জোজমাসীল / জোজনসী / তাতুরা।

পরিবারঃ Solanaceae

 ধুতুরার জাতঃ

বিশ্বের সব উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে ধুতুরা পাওয়া যায়। আমাদের দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ধুতুরা জন্মে। ধুতুরার জাতের সংখ্যা ৯টি। এটির জীবনকাল ৪-৫ বছর। এই গাছের ফুল সুন্দর হলেও কেউ সাধারণত বাগানে একে খুব একটা স্থান দেয় না। একে রাস্তার ধারেই বেশি দেখা যায় এছাড়াও অনুর্বর জমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসলি জমির ধারে জন্মাতে দেখা যায়। বাংলাদেশে ২ রকমের ধুতরা পাওয়া যায়। একটি সাদা অন্যটি কালো (কিছুটা বেগুনী রং এর)। এই দুটোর বৈজ্ঞানিক নাম Datura metel. সাদা ধুতুরা ফুলকে অনেকেই বাংলাদেশ আর ভারতের নিজস্ব জাত বলে থাকে। কালো ধুতুরার ডাঁটা ও পাতা কালচে বেগুনি রং এর হয়ে থাকে। এই ধুতুরাকে অনেক জায়গায় ‘সোনা ধুতুরা’ নামে ডাকা হয়। সোনা ধুতুরা নামটি ছাড়াও আরেকটি কমন নাম হচ্ছে “কনক ধুতুরা”।    

এই দুটো ধুতুরা ছাড়াও আরো একটি বিপন্ন জাতের ধুতুরা দেখা যায় আমাদের দেশে। যেখানে সাধারণ ধুতুরা ৩-৪ ফিট আকৃতির হয় সেখানে এই জাতের ধুতুরা ১৫-৩০ ফুট পর্যন্ত হতে দেখা যায়। এগুলোকে রাজধুতরা নামে ডাকা হয়। রাজধুতরাকে ইংরেজিতে Bragmansia নামে ডাকা হয়। এই গণের মোট প্রজাতি সংখ্যা ৭টি। ধুতুরা ও রাজধুতরা এই দুই প্রজাতির ফুল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাদা রং এর হয় এবং এগুলো রাতেই ফোটে। রাজধুতরা সাদা রং ছাড়াও হলুদ, গোলাপি, বেগুনি ও লাল রঙের দেখা যায়।

রাজধুতরার সঙ্গে সাধারণ ধুতরার মূল পার্থক্য হলো এদের ফুলের আকৃতি এবং মুখিতা। সাধারণ ধুতুরার ফুল উপরের দিকে মুখ করে ফোটে এবং আকারে হয় ৭ ইঞ্চির মত লম্বা অন্যদিকে রাজধুতরার ফুল নিচের দিকে মুখ করে ফোটে এবং লম্বায় ১ ফুটের মত হয়ে থাকে। রাজধুতুরার ইংরেজি একটি ডাক নাম Angel’s Trumpet. এটার ফুল ট্রাম্পেটের মতো ঝুলে থাকে বিধায় এমন নাম।

 ব্যবহারঃ

ধুতুরার বহুমূখি ব্যবহার রয়েছে। এর বিষাক্ততার জন্য আগেকার দিনের মলমপার্টি, অজ্ঞানপার্টির লোকেরা যেমন এটি ব্যবহার করত তেমনি ধুতুরার বীজ থেকে বানানো চেতনানাশক পদার্থ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়। এমনকি চীনা ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে উল্লেখিত প্রধান ৫০টি উদ্ভিদের মধ্যে ধুতুরা একটি।

এটা যেমন হিন্দুরা শিবপূজায় ব্যবহার করে তেমনি এটা নেশাসক্তরা গাঁজার সাথে এর পাতা মিশিয়ে নেশাকে গাঢ় করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। এই মিশ্রণটিকে চট্টগ্রামের ভাষায়  ‘বুইল্লা’ নামে ডাকা হয়। অন্যান্য অঞ্চলে আরো নাম থাকতে পারে।   

 ধুতুরার বিষাক্ততাঃ

ধুতুরার সব গুলো প্রজাতিই বিষাক্ত। মূলত এর ফুল এবং বীজ বেশি বিষাক্ত। তবে, এটি কি মাত্রায় বিষাক্ত হবে তা নির্ভর করে সেই গাছের বয়স, ঐ গাছের পরিবেশ এবং আবহাওয়ার উপর।  

ধুতুরা’য়  ৩টি বিষাক্ত উপক্ষার (Alkaloid) রয়েছে যা স্বাদ এবং গন্ধহীন। এগুলোর নাম অ্যাট্রোপিন, স্কোপোল্যামাইন ও হাইওস্কায়ামাইন। এই উপক্ষার গুলোর প্রভাবে একজন মানুষ তার চারপাশের বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে চিত্তবিভ্রম, দৃষ্টিবিভ্রম ও দিকভ্রম সৃষ্টি হয় এবং কখনো এমনভাবে স্মৃতি হারায় যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি অতীতের কথা ও ঘটনা মনে করতে পারে না। ধুতুরার অপরিমিত প্রয়োগ মৃত্যু ঘটাতে পারে। ধুতুরার বিষাক্ততার কারণেই এর চাষ, বিপনন ও বহন অনেক দেশেই আইনত নিষিদ্ধ।

ভেষজ প্রয়োগ ও গুণাগুণঃ

গ্রাম বাংলায় এর অনেক ভেষজ প্রয়োগ দেখা যায়। তবে এটা খুবই পরিমিত ব্যবহার করাই ভালো।  আমরা এখানে ধুতুরার পরিচিত কিছু ভেষজ প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব –  

কুকুরের কামড়ের প্রতিষেধক: কুকুরের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে এর ব্যবহার গ্রাম বাংলায় দেখায় যায়। ধুতুরার এক গ্রাম পরিমাণ মূলের সাথে পূনর্নবার পাঁচ গ্রাম পরিমাণ কাঁচা মূল বেটে ঠান্ডা পানি বা দুধের সাথে খাওয়ালে জলাতঙ্ক ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচা যায়।       

টাক রোগ: ধুতুরার আরেকটি অসাধারণ ভেষজ প্রয়োগ দেখা যায় টাক রোগের ক্ষেত্রে। ধুতুরার পাতার রস মাথায় প্রলেপ করে টাক রোগের চিকিৎসা করা হয়। তবে, পুরা মাথায় এক দিনেই ধুতুরার রস প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। মাথাকে দুইপাশ চিহ্নিত করে দুই দিনে লাগাতে হবে অর্থাৎ এক দিনে বেশি পরিমাণ ব্যবহার করা উচিৎ নয়।      

ক্রিমি: ক্রিমি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ধুতুরা পাতার রস ২/৩ ফোঁটা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার বিধান আছে। 

ঘাড় ও পিঠ, বাতের ব্যাথা: ঘাড় ও পিঠের ব্যাথায় ধুতুরা পাতা ও চুন একসাথে পিষে যে রস বের হবে তা ব্যাথা যুক্ত জায়গায় ব্যবহার করলে ব্যাথা নিরাময় হয়। আর, বাতে ব্যাথার প্রতিষেধক হচ্ছে, ধুতুরার পাতার রস সরিষার তেলের সাথে মিশিয়ে গরম করে যুক্ত জায়গায় মালিশ করতে হবে।          

ফোড়াঃ ধুতুরা পাতার রসের সঙ্গে কিছুটা ঘি মিশিয়ে মেখে দিলে ফোড়া পেকে যাবে। 

পায়ের গোড়ালি ফেটে যাওয়া: পায়ের গোড়ালি ফেটে যাওয়ার সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য ধুতুরার যে প্রতিষেধক প্রস্তুত করতে হবে তার জন্য প্রয়োজন হবে – সরিষার তেল ১ লিটার, ধুতুরার পাতা ডাটা সহ নিয়ে রস বানাতে হবে ২ লিটার পরিমাণ, ধুতুরার পাতা বাটা একশ গ্রাম। প্রথমে, সরিষার তেল জ্বাল দিতে হবে যাতে ফেলা চলে যায়। ফেলা চলে গেলে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। তেল ঠান্ডা হয়ে এলে ধুতুরার রস ও পাতা বাটা ধাপে ধাপে মেশাতে হবে। আনুমানিক, ১৫ মিনিট পর আরো ২ লিটার পানি মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। জ্বালের ফলে পানি শুকিয়ে যাবে। অবশিষ্ট তেল ছেকে আলাদা করতে হবে। এটিই হচ্ছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষেধক। এই তেল পায়ের গোড়ালি ফেটে যাওয়া রোধ করবে। সেই সাথে ছুলি রোগ এবং কানে, কপালে ব্যাথায় ব্যবহার করা যাবে।          

নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এর সমস্যা: দ্রুত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস হলে ধুতুরর শুকনা পাতা ও কাণ্ড গুড়ো করে বিড়ির খোলে অথবা কলকিতে ভরে আগুন লাগিয়ে ধুমপান করলে সুফল পাওয়া যায়।

আজীর্ণ: ধুতুরার ৩টি বিচি পিষে ঠান্ডা পানি দিয়ে খাবার গ্রহণের পর খেলে আজীর্ণ ভালো হয়।

স্ত্রী লোকের স্তন ব্যথায়: স্ত্রী লোকের স্তন ব্যথায় ধুতুরা পাতার রসের সাথে সামান্য পরিমাণে চুন ও হলুদ মিশিয়ে স্তনে প্রলেপ দিলে ব্যথা ভালো হয়।

উল্লেখিত বিষয় গুলো ছাড়াও আয়ুর্বেদে ধুতুরাকে অনেক রোগের প্রতিষেধক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যেমনঃ ফোলা ও ব্যথা / টাক পড়া / চর্মরোগ / হাঁপানি / কুকুরের কামড় / সাপের কামড় / পা-ফাটা / ছুলি / কানের যন্ত্রণা / ক্রিমি / স্তনের প্রদাহ / ফোড়া ও বাতের ব্যথা / পার্কিনসনস্ ডিজিজ / নিউর‍্যালজিয়া / প্রদাহজনিত জ্বর / দাঁতের ব্যথা / চুল পড়া / খুশকি / অর্শ ইত্যাদি। 

[গর্ভবতী মা’দের জন্য ধুতুরার কোনো অংশ গ্রহণ করা একবারে নিষেধ]

ধুতুরার ভেষজ প্রয়োগ এর এই অংশটি ধুতুরার গুণাগুণ গুলো সবার জানানোর উদ্দেশেই উল্লেখ করা হয়েছে। ধুতুরার কোন অংশই অভিজ্ঞ চিকিৎসক, হেকিম বা কবিরাজ এর পরামর্শ ছাড়া খাওয়া বা ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ধুতুরার বিষক্রিয়ায় মানুষ ছাড়াও পশুপাখির মৃত্যু হতে পারে। এই কারণে অনেক দেশেই ধুতুরার চাষ / উৎপাদন, বিপনন ও বহন আইনত নিষিদ্ধ। 

আমাদের পরিবেশে অন্যান্য ভেষজ’র মত ধুতুরার ও অবদান এবং প্রয়োজন আছে। এটি পরিবেশকে যেমন সাজাচ্ছে তেমনি চিকিৎসায়ও অবদান রাখছে। আমরা যদি এর বিষাক্ততা থেকে সাবধান থাকি তাহলে এটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয়। বর্তমানে এটি আগের মত সচরাচর দেখা যায় না। এর কিছু প্রজাতি বিভিন্ন দেশে বিপন্ন ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা অবশ্যই চাইব, এটা যেন আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে না যায়। 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button