Uncategorized

চুইঝাল – বাংলার অপ্রচলিত সুস্বাদু মশলা

প্রচলিত নামঃ চুইঝাল, চুই, চই, চই লতা, গজ পিপুল 

বৈজ্ঞানিক নামঃ Piper chaba

চুই গাছে যে ফল হয় সেটাকে Long pepper বা Indian Long pepper নামে ডাকা হয়। 

চুই মূলত ঝাল স্বাদের জন্য ব্যবহারিত এক ধরণের মশলা যেটা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও যশোরের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক জনপ্রিয়। দক্ষিণাঞ্চলে চুইঝাল মাংস এবং ডাল রান্নায় এটি আবশ্যকিয় উপাদান। যদিও চুই এর জনপ্রিয়তা সারা দেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে রংপুর, চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়ি এলাকাতেও চাষ হচ্ছে। এটি মশলা হিসেবে যেমন সুস্বাদু তেমনি এটির রয়েছে অনেক ভেষজ গুন।

চুইঝাল লতা জাতীয় উদ্ভিদ, যে কোন বড় গাছকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠে। চুইঝাল গাছ ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। চুই এর পাতা পান পাতার মতই। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। মশলা হিসেবে ব্যবহার হয় মূলত এটার লতার কান্ড এবং শিকড়। বাজারে এটার কান্ড এবং শিকড় মশলা হিসেবে বিক্রি হয়। পাতা এবং ফল মশলা হিসেবে ব্যবহার হয় না তবে, পাতা আর ফলের অনেক ভেষজ গুণ আছে। চুই এর কাণ্ড বা লতা কেটে ছোট টুকরো করে মাছ-মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর এই টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। চুইঝাল তরকারিকে ঝাল করলেও সেই ঝালের স্বাদ আলাদা, অন্যান্য ঝাল জাতীয় মশলার মত নয়। সেই সাথে এই মশলার আছে অদ্ভুত এর সুগন্ধ যা কিনা খাবারের স্বাদ অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। চুইঝালের যে ঝাল স্বাদ তা কিন্তু দির্ঘস্থায়ী নয় অর্থাৎ এটা খেয়ে যদি ভীষণ ঝাল লাগেও সেটা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে যায়।  

চুইঝালের উপর পাতলা একটা ছাল থাকে। ওটা ছুড়ি বা বটি দিয়ে হাল্কা চেঁছে ফেলে দিতে হয় রান্নার আগে। তবে, অন্যান্য সবজির মত একে বারে ছাল ফেলে দেওয়া যাবে না। এটা খুব দ্রুতই সিদ্ধ হয়ে যায়। তাই রান্না শেষ করার ৪/৫ মিনিট আগে দিলেই হয়। অনেকে আবার কাঁচা কান্ড লবণ দিয়ে খেতে পছন্দ করে।

পুরো চুইঝাল গাছই ছোট টুকরো করে রান্নায় দেওয়া হয়৷ তবে কেবল মাংসে নয়, মাছ, নিরামিষ, ডাল, সবজিতে ও দেওয়া যায়৷ মাংসে চুইঝাল ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি করে কেটে ব্যবহার করা হয়। 

 

চুই সাধারণত দুই প্রকার। একটির কাণ্ড আকারে বেশ মোটা (২০ থেকে ২৫ সেমি), অন্যটির কাণ্ড চিকন, (আকারে ২.৫ থেকে ৫.০ সেমি)। চুই গাছ ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।

চুইঝাল গাছ (photo credit: Mrittunjoy Roy)

চুই গাছের ফল অনেকটা পিপুল ফলের মতই, তবে আকারে বেশ বড় (প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা) হয়ে থাকে। ফলের রঙ কচি অবস্থায় থাকে সবুজ, পাকলে হয় কমলা থেকে লাল এবং শেষে ক্রমে কালো রঙ ধারণ করে। চুই এর ফল মশলা হিসেবে আমাদের দেশে ব্যবহার না হলেও থাইল্যান্ডে স্যুপে ফলের গুড়া দেওয়া হয় বলে জানা যায়।

চুই এর ফল (photo credit: Robert Lafond)
চুই এর ফল (photo credit: Robert Lafond)

চুইঝাল নিয়ে যত বিভ্রান্তিঃ

অনেকেই চুই এর ফল এর সাথে পিপুলকে গুলিয়ে ফেলে। ফল ছাড়াও পাতা এবং কান্ডের আকৃতিতেও পিপুলের সাথে মিল আছে। চুই আর পিপুল কিন্তু এক নয়। আবার অনেকেই গোল মরিচ এর সাথে আবার অনেকেই এর পাতাকে পান পাতার সাথে গুলিয়ে ফেলে। মজার ব্যাপার হলো এই চারটি উদ্ভিদই একই পরিবারের। তাদের পরিবারের নাম Piperaceae. নিচে চারটি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম আলাদা ভাবে দেওয়া হলোঃ    

চুই ঝাল (Piper chaba)

পিপুল (Piper longum)

গোল মরিচ(Piper nigrum)

পান গাছ (Piper betle)

পিপুল প্রায় সারা দেশেই পাওয়া যায়। এটির মূল এবং কাঁচাফল ভেষজ কাজে ব্যবহার হয়। পিপুলের ফল ঝাল মশলা হিসেবে প্রচলন আছে এবং এই ফলের ঝাল গোলমরিচের চেয়ে অনেক বেশি। যদিও চুইঝালের পাতা খাবার হিসেবে ব্যবহার হয় না কিন্তু পিপুলের পাতা শাক হিসেবে খাওয়া যায়। চুই আর পিপুলর আরেকটি পার্থক্য হচ্ছেচুই শিকড় দিয়ে অন্য গাছকে অবলম্বন করে উপরের দিকে বেড়ে উঠে আর পিপুল মাটিতেই গড়িয়ে বেড়ায়।  

ভেষজগুণঃ

চুই গাছের ভেষজগুণ অসামান্য। চুই এর শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল, ফল সব অংশই গুরুত্বপূর্ণ ভেষজগুণ সম্পন্ন। বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে এটি বেশ কার্যকর ভেষজ । গ্যাস নিবারণ, কোষ্ঠকাঠিন্য তাড়াতে, রুচি বাড়াতে,ক্ষুধামান্দ্য দূর করতে কার্যকর ঔষধি এটা। অর্থাৎ পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চই ঝাল উপকারী। হেচঁকি দমনে চুই ঝালের সঙ্গে মধু মিশিয়ে চিবালে উপকার পাওয়া যায়। সর্দি সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এক ইঞ্চি পরিমাণ চুই ঝালের সঙ্গে আদা পিষে খেলে সর্দি উপশম হয়। স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে ঘুম আসতে সহায়তা করে চুই ঝাল। নিয়ম করে খেলে সুনিদ্রা হয়। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, কফ, ডায়রিয়া, রক্তস্বল্পতা, শারীরিক দু্র্বলতা কাটাতে অথবা শরীরের ব্যথা সারাতে চুই ঝাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

বংশবিস্তারঃ

উঁচু জায়গাতে চুই ভালো জন্মায়, গোড়ায় পানি জমলে গাছ পচে যায়। যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় এর চাষ বেশি দেখা যায়। সুপারি, মেহগনি, আম, নারকেল সহ যে কোন বড় সাইজের গাছকে অবলম্বন করে চুইঝালগাছ বাড়তে পারে।

চুই এর বীজ থেকে চারা হয় আবার শিকড় সহ গিঁট এর কাটিং থেকেও চারা করা যায়। তবে, কাটিং থেকে চারা গজানো দ্রুত আর সহজে হয়। চুইঝাল গাছ রোপণের এক বছরের মাথায় খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে ভাল ফলনের জন্য ৪/৫ বছরের গাছই উত্তম। ৪/৫ বছরের একটি গাছ থেকে প্রায় দশ থেকে পনেরো কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। চুইঝাল প্রকারভেদে ৩০০ টাকা থেকে ১৫০০/১৬০০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়।

চুইঝাল যেমন বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদ হচ্ছে তেমনি ঘরোয়া ভাবেও এটি চাষ করা হয় বিশেষ করে  দক্ষিণাঞ্চলের দিকে। বর্তমানে অনেক শহুরে শখের বাগানীরাও এটি সল্প পরিসরে চাষ করে থাকে।     

চুইঝালের জন্য যে হোটেল গুলো বিখ্যাতঃ চুইঝাল খাওয়ার জন্য হোটেলের কথা আসলে সবার আগে নাম আসবে “আব্বাসের হোটেলের” কথা। “আব্বাসের খাসির মাংস” – এই নামটা খুলনা অঞ্চলের সবার মুখে মুখে। যে সব ভোজনরসিকেরা খুলনা ট্যুরে যায় তারা অন্তত একবার আব্বাসের হোটেলে খাওয়ার পরিকল্পনা করে যায়। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খুলনা সাতক্ষীরা সড়কের চুকনগর বাজারে আব্বাসের হোটেলের অবস্থান। খুলনা’র বেজের ডাঙ্গায় অবস্থিত “মুসলিম হোটেল” ও চুই ঝালের গরুর মাংসের জন্য বিখ্যাত।

ঢাকা বাসিন্দাদের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উল্টোদিকেও ‘চুই ঝাল রেস্টুরেন্ট’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট আছে। তাদের  চুঁইঝাল দিয়ে গরুর মাংস বেশ নাম করা। মধ্য পাইকপাড়া, মিরপুরে আছে ‘চুই গোশ’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট। উত্তরা সেক্টর ৩, রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের পিছনে এদের আরেকটি শাখা আছে।

চট্টগ্রামের “ড্রাইভার হোটেল” ও চুইঝাল আর গরুর মাংসের জন্য বেশ বিখ্যাত। “ড্রাইভার হোটেল”- এর লোকেশন হচ্ছে সীতাকুন্ড, ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের, বায়তুস শরফ কমিউনিটি সেন্টারের পাশে।  

 
বিভিন্ন বই, প্রবন্ধ থেকে তথ্য সংগ্রহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button