অপ্রচলিত ভেষজ চা [১ম পর্ব]
আমরা প্রচলিত যে চা পান করি তার বাইরেও বিভিন্ন ভেষজ উপাদানে চা বানানো সম্ভব। যেগুলো প্রচলিত চা এর মত বা কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত চা এর চেয়েও পুষ্টিকর এবং সাস্থ্যসম্মত। তেমনই কিছু অপ্রচলিত চা নিয়েই এই ধারাবাহিক আর্টকেল। এখানে সেই সব অপ্রচলিত চা এর ভেষজ চা এর উপাদান, রেসিপি এবং উপকারিতা সম্পর্কে জানব।
জবা ফুলের চা
জবা ফুল (হিবিসকাস) Hibiscus পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই পরিবারের মূলত ৩টি species এর ফুল থেকে চা প্রস্তুত করা হয়। species গুলো হলোঃ
১. Hibiscus sabdarrifa
২. Hibiscus Rosa-sinensis
৩. Hibiscus syriacus
এখানে, Hibiscus sabdarrifa হলো মেস্তা, যেটাকে চুকই বা চুকর ও বলা হয়ে থাকে। Hibiscus Rosa- sinensis হচ্ছে রক্তজবা বা লাল রং এর জবা যেটা আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এখন আমরা আলোচনা করছি ২ আর ৩ নং জবা ফুল সম্পর্কে। মেস্তার চা নিয়ে পরের অংশে আলোচনা করা হয়েছে।
উপকারিতাঃ
– এই চা আমাদের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি আমাদের বাওয়েল মুভমেন্ট এর উন্নতি সাধন করে। এই ফুলে থাকা ডিউরেটিক প্রপাটিজ খাদ্য দ্রুত হজমে সাহায্য করে একই সাথে কনস্টিপেশনের মত সমস্যার ও সমাধান হয়।
– জবা ফুলের চা ওজন কমাতেও সাহায্য করে। এই চা এ থাকা বিশেষ কিছু উপাদান শরীরের অ্যামিলেস নামক উপাদানের উৎপাদন কমিয়ে দেয় যার ফলে ওজন কমে যায়।
– এই চা এ আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট প্রপাটিজ যা আমাদের শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় যার ফলে হার্ট সুস্থ থাকে এবং হার্টের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। একই সাথে জবা ফুলের চা পেপটিক আলসারের মত রোগ ও প্রতিরোধ করে।
– এই চা এ থাকা অ্যাসকর্বিক অ্যাসিড ভিটামিন সি-এর ঘাটতি কমায় যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এটি একই সাথে সর্দি কাশি নিরাময়েও কার্যকর।
– জবা ফুলের চা এ থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের রক্তে মিশে থাকা টক্সিক উপাদান বের করে দেয় যা আমাদের লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। অ্যাংজাইটি কমাতেও এই চা কার্যকর।
যেভাবে তৈরি করবেনঃ
উপকরণঃ
– পানি ২ কাপ
– ১টি লবঙ্গ
– ২টি গোলমরিচ
– ২টি জবা ফুল
– মধু (স্বাদ অনুযায়ী)
প্রথম একটা পাত্রে পানি, লবঙ্গ ও গোলমরিচ দিয়ে ফুটিয়ে নিতে হবে যখন পানি দেড় কাপে নেমে আসবে তখন একটা বাটিতে নামিয়ে নিতে হবে। তারপর জবা ফুলের পাপড়ি গুলো ছিড়ে জল দিয়ে ১-২ মিনিট রেখে দিতে হবে। তারপর একটা ছাকনি দিয়ে ছেকে নিতে হবে। তারপর এর মধ্যে স্বাদ অনুযায়ী মধু দিতে হবে তাহলেই রেডি হয়ে গেল জবা ফুলের চা।
সতর্কীকরণঃ
* যারা anti-inflmmatory বা acetoaminophen জাতীয় ওষুধ সেবন করে তাদের এই চা সেবন না করাই ভালো।
* গর্ভবতী মহিলাদের জবা ফুলের চা সেবন নিরাপদ নয়।
* যেহেতু জবা ফুলের চা সেবনে ঘুমঘুম ভাব আসে সেহেতু এই চা সেবনের পর ড্রাইভিং, ভারী কাজ বা বিপদজনক যন্ত্র চালানোর থেকে দূরে থাকতে হবে বা এই ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।
চুকাই / চুকুর / মেস্তা চা / রোজেলা টি
এখন আমরা যে গাছের ফুলের চা নিয়ে কথা বলব তা হচ্ছে জবা পরিবারের সদস্য। জবা ফুলের চা নিয়ে লিখার অংশে আমরা জবার ৩টা জাতের নাম উল্লেখ করেছিলাম তার মধ্যে Hibiscus sabdarrifa একটি। যাকে বাংলায় চুকাই বা চুকুর বা মেস্তা বলা হয়। যার ইংরেজি নাম রোজেলা (Rosella) ইংরেজি নাম অনুসারে এই চা কে রোজেলা টি নামে ডাকা হয়।
যদিও চুকাই বা চুকুর আমাদের দেশে তরকারী হিসেবে বা জ্যাম, জেলী, চাটনিতে দিয়ে বেশিরভাগ সময় খাওয়া হয় কিন্তু এটি দিয়ে যে চা প্রস্তুত করা হয় এটা আমাদের দেশে অনেকেই জানে না। এই চা আমাদের দেশে তেমন প্রচলন ও নেই তবে অনেক দেশেই এই চা জনপ্রিয় বিশেষ করে দক্ষিন আমেরিকার দেশ গুলোতে।
অন্যান্য নামঃ চুকাই / চুকুর / চুকর / চুকইর / চুকরি / চুপুরি / চুকোর / চুপড় / চুকা / টেঙ্গামোড়া / চুক্কি / চুই / মেস্তা / খিইরুপ / হরঅগডা / সৌলফা / টক ঢ্যাঁড়স।
ইংরেজি নামঃ Rosella / Sorrel / Roselle / Jamaica sorrel / Red sorrel
বৈজ্ঞানিক নামঃ Hibiscus sabdarrifa
উপকারিতাঃ
– এই চা এর সব থেকে ভালো দিক হলো Diabetes mellitus এর ক্ষেত্রে এর ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রনের ভূমিকা। চুকাই এর বিজলযুক্ত রক্তীম পাপড়ির মত সেপাল শুকিয়ে চা বানানোর প্রথা আমাদের দেশে খুব একটা না থাকলেও দক্ষিন আমেরিকার দেশ গুলোতে এটা বেশ জনপ্রিয়।
এই ফুলের চা দেখতে আকর্ষনীয় লাল বর্ণের ও টক স্বাদ বিশিষ্ট, এতে রয়েছে সিট্রিক অ্যাসিড, ম্যালিক অ্যাসিড, টার্টারিক অ্যাসিড। এতে রয়েছে ফ্লাভানয়েড গ্লায়কোসাইড, সায়নিডিন এবং ডেলফিনিডিন যার দরুন এই চা তার বৈশিষ্টমূলক লাল বর্ণ ধারণ করে।
– উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে এই কিছুটা চা সহায়ক বলে ধারণা করা হয়।
– ওজন কমাতে এই চা বেশ কার্যকর।
– ঘুম ও স্নায়ুর উপর চাপ কমাতে এই চা বেশ কার্যকর।
যেভাবে তৈরি করবেনঃ
এই চা তৈরির প্রক্রিয়া জবা ফুলের চা এর মতই তাই আলাদা কোন নিয়ম উল্লেখ করা হলও না। তবে এই চা গরম কিংবা ঠাণ্ডা উভয় পদ্ধতিতেই পরিবেশন করা হয়। স্বাদের জন্য আদা, লবঙ্গ , দারুচিনি, মধু মেশানো যেতে পারে।
জিরা চা
ইংরেজী নামঃ Cumin
বৈজ্ঞানিক নামঃ Cuminum cyminum
আমরা অনেকেই হয়ত জানি না, আমাদের প্রতিদিনের রান্নার উপাদান এই জিরা দিয়ে চা বানানো যায়, যেটা একই সাথে ওজন কমাতে যেমন সাহায্য করে তেমনি আমাদের হজমশক্তিতেও আরো মজবুত করে। তাছাড়া অনেকেই এর ঘ্রাণ অনেক পছন্দ করে।
পুষ্টিবিদদের মতে, শরীরে জমে থাকা বর্জ্য পদার্থ ধীরে ধীরে হজম ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। জিরা চা সেই বর্জ্য পদার্থ গুলো শরীর থেকে বের করে দেয় যার ফলে এটি আমাদের শরীর এর ওজন কমাতে সাহায্য করে। জিরা চা রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
যেভাবে তৈরি করবেনঃ
– পানি ২ কাপ
– আস্ত জিরা ১ টেবিল চামচ,
– মধু (স্বাদ অনুযায়ী)
প্রথমে, একটি পাত্রে জিরা হালকা গরম করে নিতে হবে। এবার এটা পানি দিয়ে ফুটান। পানি কমে এলে চুলা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন। এরপর নামিয়ে চা ছেঁকে নিন। এবার স্বাদ অনুযায়ী মধু মেশাতে পারেন তবে চিনি ব্যবহার না করাই উত্তম।
অরিগ্যানো চাঃ এই চা নিয়ে পূর্বে “অরিগ্যানো কি ? এর ব্যবহার, উপকারিতা এবং রেসিপি” নামক পোষ্টে আলোচনা করা হয়েছিল, চাইলে লিংকে ঢুকে দেখে নিতে পারবেন
এই পর্বের উল্লেখিত ভেষজ চা গুলো ছাড়াও আরও অনেক রকমের চা পাওয়া যায় যেগুলো আমরা সহজেই ঘরে বসেই বানাতে পারি। ধারাবাহিক ভাবে আগামী পর্ব গুলোতে এই সব ভেষজ চা নিয়ে আলোচনা থাকবে।