কলা গাছের প্রতিটি অংশের উপকারিতা, ব্যবহার ও স্বাস্থ্যগুণ [দ্বিতীয় পর্ব]

এটি “কলা গাছের প্রতিটি অংশের উপকারিতা, ব্যবহার ও স্বাস্থ্যগুণ” আর্টিকেলের দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি কলা গাছের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ—ফুল বা মোচা নিয়ে। মোচার নানা উপকারিতা, ব্যবহার ও পুষ্টিগুণ সত্যিই আমাদের অনেকের অজানা ছিল। এবার দ্বিতীয় পর্বে চলুন একটু এগিয়ে যাই—এই পর্বে আমরা জানব কলা গাছের থোর (বা কান্ড) এবং বাকল নিয়ে। অনেকেই জানেন না, এই দুইটি অংশও নানা উপায়ে আমাদের কাজে লাগে—খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে। চলুন দেখি, কীভাবে এই সহজলভ্য গাছটির আরও গভীরতর ব্যবহার আমাদের জীবনের উপকারে আসতে পারে।
কলার থোর / কান্ড এবং বাকলের ব্যবহার
কলার থোর হচ্ছে সেই সাদা মসৃণ কাণ্ড, যা কলা গাছ থেকে কলা তোলার পর কেটে ফেলা হয়। একটি কলাগাছে একবার কলা ধরার পর সেটিতে আর নতুন করে কলা আসে না, তাই গাছটি কেটে ফেলতেই হয়। এই কাটা গাছের ভেতরের অংশই হলো থোর। থোরে প্রচুর আয়রন, ক্যালসিয়াম আর পটাসিয়াম থাকে, যা শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
- কলাগাছের কাণ্ডের ছাল দিয়ে ভালো মানের দড়ি তৈরি করা যায়।
- এই ছাল পুড়িয়ে কাপড় কাচার সোডার মতো কাজে ব্যবহার করা যায়।
- অনেক দেশে কাণ্ডের ছাল প্রেস করে (সালপাতার মতো) ওয়ান-টাইম প্লেট বা থালা বানানো হচ্ছে।
- পুকুরে যদি মাছ ভেসে ওঠে, তখন কলাগাছ কেটে পানিতে ফেললে পানির দূষণ কমে যায়। কলাগাছ পটাশিয়ামের (Potassium) মতো কাজ করে।
- কলাগাছের ছাইয়ের সঙ্গে কিছু তেঁতুল আর এঁটেল মাটি (যেখানে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে) মিশিয়ে নিলে খুব ভালো পরিষ্কারক তৈরি হয়। এই মিশ্রণ গরম পানির সাথে ব্যবহার করলে মোটা কাপড় ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায়।
- কলাগাছের বাকল বা খোল ছোট চারা গাছের জন্য ছায়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়, যাতে রোদে চারাগাছ পুড়ে না যায়।
- খই ভাজার সময় গরম বালু রাখতে কলার খোল খুব ভালোভাবে কাজে লাগে, কারণ এটা তাপ সহ্য করতে পারে।
- ছোট্ট বাচ্চারা কলার খোল দিয়ে খেলাচ্ছলে ছোট ইটের ভাঁটা বা মাটির বাড়ি তৈরি করে মজা পায়।
- কলার খোল ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।
- কলাগাছ পুরোপুরি কাঠের মতো শক্ত নয়। এর গুঁড়িতে অনেক পানি থাকে (water-storing tissue), তাই এটা হালকা ও ভাসমান হয়। গ্রামের মানুষ এই গাছ কেটে দ্রুত অস্থায়ী ভেলা বানায়। পানিপথ পার হতে বা বন্যার সময় এই ভেলা অনেক কাজে লাগে।
- আগে গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে কলাগাছের খোল আর শিমুল ফুল রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ক্ষার তৈরি করা হতো। এই ক্ষার মাটির কলসিতে জমিয়ে রাখা হতো। পরে গৃহিণীরা সেই ক্ষার ব্যবহার করে কাপড়-চোপড় ধোত। তখন সাবান বা ডিটারজেন্টের এত সহজলভ্যতা ছিল না, তাই এই প্রাকৃতিক ক্ষারই ছিল কাপড় পরিষ্কার করার একটি ঘরোয়া উপায়।
- শুকনো থোড় গুঁড়ো করে ১ চা চামচ পরিমাণ নিয়ে তার সঙ্গে ১ চা চামচ চিনি ও ১ চা চামচ জল মিশিয়ে খেলে শরীরের ভেতরের ঠান্ডা ভাব কমে, ফলে শরীর গরম হতে সাহায্য করে। এটি প্রস্রাবে জ্বালা বা কষ্ট এবং কিছু যৌন সমস্যা উপশমেও উপকারী।
- প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেলে বা আটকে থাকলে, ৪ চা চামচ পরিমাণ থোড়ের রস হালকা গরম করে তাতে আধা চা চামচ ঘি মিশিয়ে খেলে অনেক সময় দ্রুত প্রস্রাব হতে শুরু করে। এটি একটি ঘরোয়া পদ্ধতি
কলার থোর দিয়ে বানানো রেসিপিগুলো –
ভর্তা ও চাটনি জাতীয় রেসিপি – থোরের ভর্তা (সাধারণ) / সরষে-মরিচ দিয়ে থোর ভর্তা / রসুন ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ঝাল ভর্তা / থোর-টমেটো চাটনি / পুদিনা ও দই দিয়ে থোর চাটনি (ফিউশন)
ভাজি ও শুকনো রেসিপি – থোরের ভাজি (রসুন ও নারকেল দিয়ে) / থোর-আলুর ভাজি / থোর-শুঁটি (green peas) শুকনো তরকারি / থোর ও বেগুনের মিক্স ভাজি / মোচার মতো থোরের ঘন্ট (কষানো)
বড়া, চপ ও কাটলেট জাতীয় রেসিপি – থোরের বড়া / থোর-বেসনের পাকোড়া / থোরের স্পাইসি চপ / থোর-আলু পেটিস / থোর দিয়ে ভেজ কাটলেট (breadcrumbs coat করে)
কারি ও ঝোল জাতীয় রেসিপি – থোরের ঘন্ট (নিরামিষ স্টাইল) / ছোলার ডাল দিয়ে থোরের তরকারি / পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে ঝাল থোরের দম / চিংড়ি দিয়ে থোরের কারি (নন-ভেজ) / মাটন বা কিমা দিয়ে থোর রান্না (বাঙালি ফিউশন)
ডাল ও খিচুড়ি জাতীয় রেসিপি – থোর দিয়ে মিক্সড ডাল / থোর ও মুং ডাল খিচুড়ি / থোর ও পালং শাক দিয়ে পাতলা ডাল / থোর দিয়ে মসলাদার ডাল তড়কা
আধুনিক ও ফিউশন রেসিপি – থোরের পরোটা (stuffed paratha) / থোর দিয়ে স্প্রিং রোল ফিলিং / থোর-চিকেন কাটলেট (ফিউশন) / থোর দিয়ে ভেজান স্যান্ডউইচ ফিলিং / থোর পেস্ট দিয়ে পাস্তা সস / থোর ও সুজি দিয়ে হেলদি উপমা
আচার, স্যালাড ও হেলদি বাউল – থোরের কাঁচা স্যালাড (lemon-mustard dressing) / থোর ও শসা দিয়ে ডিটক্স সালাদ / থোরের আচার (সরিষা ও রসুন দিয়ে) / থোর-বিনস বাউল (হাই প্রোটিন ফিউশন ফুড) / থোর ও দই দিয়ে গ্রীন ডিটক্স বাটার মিল্ক
যদি থোর দিয়ে এসব রেসিপি আগে না খেয়ে থাকেন, তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখতেই পারেন। ইউটিউব বা গুগলে একটু খোঁজ নিলেই সহজ রান্নার উপায় পেয়ে যাবেন। স্বাদ, পুষ্টি আর ঘরোয়া উপকরণ সব একসাথেই পাবেন এই খাবারগুলোতে।
চলমান —